ইসলামের পতাকার ইতিহাস

প্রথম পতাকা

ইসলামে পতাকার প্রচলন ঘটে হিজরতের সময়। হজরত নবী করিম ﷺ হিজরতের উদ্দেশ্যে যখন মদিনার পথ ধরেন, রাস্তায় বারিদা নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাত হয়। পুরস্কারের লোভে রাসূল ﷺ কে ধরতে এসেছিলো। কিন্তু সে মুসলমান হয়ে রাসূল ﷺ এর সঙ্গী হয়ে যান।
বারিদা (রা.) নবী করিম ﷺ কে বলেন, মদিনায় প্রবেশকালে আপনার একটি পতাকা থাকা দরকার। তখন নবী করিম ﷺ মাথা থেকে পাগড়ী খুলে, বর্শার মাথায় বেঁধে হজরত বারিদা (রা.) কে দেন। রাসূল ﷺ মদিনায় প্রবেশের সময় হজরত বারিদা (রা.) সেটিকে পতাকা হিসেবে ব্যবহার করেন। শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতীক হিসেবে ওই পতাকা ব্যবহার হয়েছিলো। এটাই ইসলামের প্রথম পতাকা। তবে বারিদা নিজের পাগড়ীকেই পতাকা হিসেবে ব্যবহার করেছিলো বলে অনেক বর্ণনায় পাওয়া যায়। (যরকানী, শরহু মাওয়াহিবিল লাদুনিয়্যাহ, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-১৭৩)

ইবনুল আছির আলজাজারি তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আল কামেল’ এ লেখেন, ‘হিজরতের প্রথম বছর সাত মাস অতিবাহিত হওয়ার পর, রাসূল ﷺ স্বীয় চাচা হামজার হাতে পতাকা ওঠিয়ে দেন। পতাকার রং ছিলো সাদা। বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিলো ত্রিশজন। তাদেরকে প্রেরণ করা হয়েছিলো কুরাইশদের একটি কাফেলাকে ধাওয়া করার জন্য। পথে আবু জাহেলের সঙ্গে সাক্ষাত হয়। কিন্তু মাজদি ইবনে আমর আলজুহানি নামক একজন নেতার মধ্যস্ততায় যুদ্ধ থেকে উভয় পক্ষ বিরত থাকে। মুসলমানদের পতাকাবাহী ছিলেন আবু মুরছাদ (রা.)। ওই পতাকাই নবী করিম ﷺ সর্বপ্রথম বেঁধেছিলেন।’ (আল কামেল ফীত তারিখ, খন্ড-২, পৃষ্ঠা-১২)

তবে দুই বর্ণনায় সামঞ্জস্য বিধান সম্ভব এভাবে যে, যুদ্ধের পতাকা হিসেবে হামজা (রা.) এর পতাকা ইসলামে সর্বপ্রথম। আর সাধারণ পতাকা হিসেবে হজরত বারিদা (রা.) এর পতাকা প্রথম। আল্লাহ তায়ালাই উত্তম জানেন।

রাসুল ﷺ এর পতাকার রং

রাসূল ﷺ দু’ধরনের পতাকা ব্যবহার করতেন। ‘রায়া’ ওই পতাকা যা যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাপতির জন্য ব্যবহৃত হতো। এই পতাকার নিচে থেকেই বাহিনী যুদ্ধ করতো। যতক্ষণ পতাকা উড়তো ততক্ষণ যুদ্ধ চলতো। ময়দানে কখনো বিশৃঙ্খলা হলে নিজেদের সৈন্যদলকে চিহ্নিত করার মাধ্যম ছিলো এই পতাকা। বদর যুদ্ধে এই পতাকা ছিলো হজরত আলী ও সাদ ইবনে মুআজ (রা.) এর হাতে। এই পতাকার রং ছিলো কালোর ভেতর সাদা দিয়ে ইসলামের কালেমা। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নম্বর-২৫৯১)

দ্বিতীয় পতাকা ছিলো ‘লিওয়া’। এটা ছিলো রাষ্ট্রের প্রতীক। রাষ্ট্রপ্রধান বা ইমামুল মুসলিমিন এই পতাকা ব্যবহার করতেন। যুদ্ধের ময়দানে এই পতাকা বর্শার অগ্রভাগে বেঁধে রাখা হতো। বদর যুদ্ধে এই পতাকা ছিলো হজরত মুসআব ইবনে উমাইর (রা.) এর হাতে। এই পতাকার রং ছিলো সাদার ভেতর কালো দিয়ে ইসলামের কালেমা। হজরত জাবের (রা.) বলেন, ‘মক্কা বিজয়ের দিন নবী করিম ﷺ এর হাতে সাদা পতাকা ছিলো।’ (আবু দাউদ, হাদিস নম্বর-২৫৯২)

রায়া (ডানে) ও লিওয়া (বামে)

দুই রঙের পতাকা ব্যবহারের বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। সাদা পতাকা ব্যবহার দ্বারা বুঝানো হয়েছে, ইসলাম সহজ-সরল জীবনব্যবস্থা। এর অনুসারীদের জীবন লৌকিকতা মুক্ত। এখানে ভীতিপ্রদর্শন, কঠোরতা ও বক্রতার কোনো স্থান নেই। এমন কি যারা ইসলামি রাষ্ট্রে অমুসলিম হিসেবে বসবাস করবে, তাদের ওপরও কোনো চাপ প্রয়োগ করা যাবে না।

নবী করিম ﷺ এর যুদ্ধের পতাকার রং ছিলো কালো। কালো হচ্ছে আতঙ্ক ও ভয়ের চিহ্ন। এর দ্বারা বিরোধীদেরকে বার্তা পৌঁছানো হতো যে, যারা সাম্য ও ন্যায়ের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে তাদের প্রতি ইসলাম কোনো রহম দেখাবে না। তারা শুধু ইসলামের কঠোরতাকে দেখতে পাবে। এক হাদিসে এসেছে, রাসূল ﷺ এর পতাকার বর্ণ হলুদ ছিলো। যেমন হজরত সেমাক ইবনে হারব নামক একজন সাহাবি বলেন, ‘আমি রাসূল ﷺ এর জন্য হলুদ বর্ণের পতাকা দেখেছি।’ (আবু দাউদ, হাদিস নম্বর-২৫৯৩)

কোনো কোনো বর্ণনায় পাওয়া যায়, নবী করিম ﷺ বনু সুলাইম গোত্রকে লাল বর্ণের পতাকা দিয়েছিলেন। আল্লামা আইনি বলেন, বর্ণনার এই বিরোধগুলোর সমাধান হচ্ছে, বিভিন্ন সময়ে নবী করিম (সা.) বিভিন্ন বর্ণের পতাকা ব্যবহার করতেন। তবে রাষ্ট্রীয় পতাকা হিসেবে সাদা এবং যুদ্ধের পতাকা হিসেবে কালো বর্ণের পতাকাই নবী করিম ﷺ অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যবহার করতেন।

রাসূল ﷺ এর পতাকার নাম

নবী করিম ﷺ স্বীয় পতাকার নাম রেখেছিলেন ‘উকাব’ العقاب। উকাব আরবি শব্দ। বাংলা অর্থ হচ্ছে ঈগল। উর্দুতে বলা হয় শাহীন। এই শব্দ দ্বারা নামকরণের কারণ হচ্ছে, ‘উকাব’ পাখিদের সর্দার। কোনো পাখি এর সঙ্গে মোকাবিলা করার সাহস পায় না। ‘উকাব’ নির্ভীকতা, ক্ষীপ্রতা ও সৌখিনতার প্রতীক। নববী পতাকাবাহীদের মাঝেও এই গুণগুলোর সমাহার ঘটেছিলো। তাই এই শব্দে নামকরণ করা হয়েছে। বর্তমান বিশ্বেও বিভিন্ন দেশের পতাকায় ও বাহিনীর প্রতীকে ঈগলের ছবি ব্যবহার হয়। ঈগল নিয়ে বহু কবিতা ও সাহিত্য রচনা হয়েছে। প্রাচ্যের কবি আল্লামা ইকবাল ঈগল নিয়ে বহু কবিতা রচনা করেছেন। মুসলিম যুবকদেরকে লক্ষ্য করে বলেছেন, ‘যখন মুসলমান নওজোওয়ানদের ভেতর ঈগলের আত্মা জাগবে বিশ্ব জয়ের নেশায় তারা মত্ত হয়ে যাবে।’

রাসূল ﷺ এর পরবর্তী যুগে ইসলামের পতাকা

যুদ্ধের পতাকা রাসূল ﷺ এর পরবর্তী যুগেও কালো বর্ণের ছিলো। তবে রাষ্ট্রীয় পতাকায় সময়ে সময়ে পরিবর্তন এসেছে। প্রথম দুই যুগ অর্থাৎ রাসূল ﷺ ও তাঁর চার খলিফা এবং উম্মাইয়াদের সময়ে পতাকার রং আগের মতোই সাদা ছিলো। আব্বাসীয়াদের আমলে পতাকার রং ছিলো কালো। শীয়া মতাদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত ফাতেমিদের পতাকার রং ছিলো সবুজ। উসমানীয়দের পতাকা ছিলো লালের মাঝে অর্ধচন্দ্র।

ইসলামের পতাকা বনাম আইএস এর পতাকা

ইরাক-সিরিয়া ভিত্তিক উগ্র জিহাদিষ্ট গ্রুপ আইএস বা কথিত ইসলামিক স্টেট (পূর্ব নাম ISIL) এর পতাকার সাথে অনেকেই ইসলামের কালো পতাকা মিলিয়ে ফেলেন যা একটি মারাত্মক ভুল। আইএস এর পতাকার রং কালো হলেও এর ভেতরে সাদা হরফে শুধু লিখা আছে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ এবং সাদা কালিতে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর মোহর

আইএস এর পতাকা, জিহাদিষ্ট ফ্ল্যাগ
রাসূল ﷺ এর মোহর

আইএস এর এই পতাকাটি রাসূলুল্লাহ ﷺ মোহরের সম্বলিত পতাকা যা ইতিমধ্যে ইতিহাসে কখনো ব্যবহার করা হয়নি। তাই বিষয়টি নতুন ও যুগ যুগ ধরে আসা কালো পতাকার সাথে এর কোন মিল নেই।

অনেক সংগঠন ও রাষ্ট্রের নিজস্ব কোন পতাকা নেই। যেমন হিযবুত তাহরীর- এর নিজস্ব কোন পতাকা নেই, তারা ইসলামের সাদা ও কালো পতাকা ব্যবহার করে থাকে। আবার ইসলামি ইমারাত আফগানিস্তানের জাতীয় পতাকা হলো ইসলামের আল লিওয়া বা রাষ্ট্রীয় সাদা পতাকা। আফগানিস্তানের মুজাহিদ ও সেনাবাহিনীর পতাকা রায়া বা কালো পতাকা। ইসলামের পতাকা যেহেতু অনেকেই ব্যবহার করে থাকে তাই শুধুমাত্র পতাকা ব্যবহারের উপর ভিত্তি করে কাওকে নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা দলের সমর্থক মনে করাটা বোকামি। রাসূল ﷺ এর যূগ থেকেই সাদা ও কালো পতাকা দুটি শাহাদাতের চিহ্ন (Symbol of Shahadah) হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

ইমাম মাহদীর সাথে কালো পতাকার সম্পর্ক

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে হারিস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “পূর্বদিক (খোরাসান) থেকে কিছু লোক বের হয়ে আসবে, যারা ইমাম মাহদির খিলাফত প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করবে এবং খিলাফত প্রতিষ্ঠা সহজ করে দিবে”। (সহিহ মুসলিম, খণ্ড ৩, হাদিস নং ২৮৯৬; সুনানে ইবনে মাজা, খণ্ড ৩, হাদিস নং ৪০৮৮)

“যখন তোমরা দেখবে, কালো পতাকাগুলো খোরাসানের দিক থেকে এসেছে, তখন তাদের সাথে যুক্ত হয়ে যেও। কেননা, তাদেরই মাঝে আল্লাহর খলীফা মাহদি থাকবে”। (মুসনাদে আহমাদ, খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ২৭৭; কানজুল উম্মাল, খণ্ড ১৪, পৃষ্ঠা ২৪৬; মিশকাত শরীফ, কেয়ামতের আলামত অধ্যায়)

“ঐ দিক থেকে একটি দল আসবে (হাত দিয়ে তিনি পূর্ব দিকে ইশারা করলেন)। তারা কালো পতাকাবাহী হবে। তারা সত্যের (পূর্ণ ইসলামী শাসনের) দাবী জানাবে, কিন্তু তাদেরকে দেওয়া হবে না। দুইবার বা তিনবার এভাবে দাবী জানাবে, কিন্তু তখনকার শাসকগণ তা গ্রহণ করবে না। শেষ পর্যন্ত তারা (ইসলামী শাসন ব্যবস্থার দায়িত্ব) আমার পরিবারস্থ একজন লোকের (ইমাম মাহদির) হাতে সোপর্দ করে দিবে। সে জমিনকে ন্যায় এবং নিষ্ঠার মাধ্যমে ভরে দিবে, ঠিক যেমন ইতিপূর্বে অন্যায় অত্যাচারের মাধ্যমে ভরে দেওয়া হয়েছিল। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যদি কেউ ঐ সময় জীবিত থাকো, তবে অবশ্যই তাদের দলে এসে শরীক হয়ে যেও – যদিও বরফের উপর কনুইয়ে ভর দিয়ে আসতে হয়”। (আবু আ’মর আদ দাইনিঃ ৫৪৭, মুহাক্কিক আবু আবদুল্লাহ সাফেঈ হাদিসটিকে সহীহ বলেছেন)

হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
“যখন কালো পতাকাগুলো পূর্ব দিক (খোরাসান) থেকে বের হবে, তখন কোন বস্তু তাদেরকে প্রতিহত করতে সক্ষম হবে না। এমনকি এই পতাকাকে ইলিয়ায় (বাইতুল মুকাদ্দাসে) উত্তোলন করা হবে (খেলাফত প্রতিষ্ঠা করবে)”। (সুনানে তিরমিজি, হাদিস নং ২২৬৯;মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং ৮৭৬০)

ডাউনলোড করুন ইসলামের পতাকা

Refs:

Hadith of black flags

Black Standard
Islamic flag

Seal Of Muhammad ﷺ